নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অর্জন করায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস
দেলোয়ার হোসেন
ইতিহাস সৃষ্টি করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের নারীরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অর্জন করায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন মারিয়া মান্দা সানজিদা আক্তারদের বিশাল সাফল্যে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই কলসিন্দুর গ্রামে আনন্দের ঢেউ আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন চার শিক্ষার্থী, বর্তমান দুই শিক্ষার্থীসহ ছয়জন। তাঁরা হলেন মারিয়া মান্দা,শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার ও শিউলি আজিম। টুর্নামেন্টে তহুরা ভুটানের বিপক্ষে ৩ গোল, ভারতের বিপক্ষে ২ গোল ও শামসুনাহার জুনিয়র ১ গোল দিয়েছেন। দেশের নারী ফুটবল মাতাচ্ছে অজপাড়া গাঁ কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা একদল কিশোরী ফুটবলার। তাদের পায়ের জাদুতে দেশের ধুঁকতে থাকা ফুটবলে ফিরেছে আশার আলো। দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে তারা, লাল সবুজের পতাকাকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরেছে। একইসঙ্গে পরিচিতি এনে দিয়েছে ছায়া সুনিবিড় কলসিন্দুর গ্রামকে।
উচ্ছ্বসিত এলাকাবাসী এখন তাদের সোনার মেয়েদের বরণ করে নেওয়ার প্রহর গুনছেন। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জয় পাওয়ার পর থেকেই কলসিন্দুর তথা ধোবাউড়া উপজেলাসহ গোটা ময়মনসিংহ জেলায় আনন্দের বন্যা বইছে।
কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মেয়েদের রুপকথার গল্প শুরু হয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও এখন এই মেয়েদের জয়জয়কার। অজোঁপাড়া গাঁয়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন এলাকার মেয়েরা ফুটবল খেলবে এটা দুঃস্বপ্নের মত ছিল। কিন্তু প্রতিকুলতার সেই শিকল ভেঙে এই মেয়েরা একের পর এক গল্প লিখছেন সাফল্যের। নারী ফুটবলের আঁতুড়ঘরখ্যাত কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে মিষ্টিমুখ করেন শিক্ষক, কোচ ও খুদে ফুটবলাররা। পাশাপাশি গ্রামের চ্যাম্পিয়ন পাহাড়ি কন্যাদের বরণ করে নিতে অপেক্ষা করছেন।
সানজিদা বলেন,দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ খুবই ভালো লাগছে। এবার হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। শুরু থেকে আমাদের পাশে ছিলেন ভবিষ্যতেও সবার সাপোর্ট চাই, দেশবাসীর ও নিজ এলাকার মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
মেসিখ্যাত শারাবান তহুরা বলেন, সিনিয়র টিমে প্রথম হ্যাট্রিক করেছি,খুবই ভালো লাগছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধও ছিলাম।
মারিয়া মান্দা বলেন,আমার বাড়ি নেতাই নদীর পাড়ে মন্দির ঘোনা গ্রামে সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় বাড়ির সামনে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গেছে। এতে পরিবারের লোকজনের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি রাস্তাঘাট মেরামতের দাবি জানান।
সানজিদার বাবা লেয়াকত আলী বলেন,’এলাকাবাসীর মতো আমার গর্বও প্রকাশ করার মতো নয়। এটা আমাদের জীবনের সেরা আনন্দ।’ আমার মেয়ে ফুটবল খেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে,আমি অনেক খুশি।
তহুরার বাবা ফিরোজ মিয়া বলেন, শুরুতে ফুটবল খেলতে অনেকে নিষেধ করতাম, এখন দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। বাবা হিসেবে আমার কাছে খুবই আনন্দের।
মেয়েদের স্থানীয় কোচ জুয়েল মিয়া বলেন, আমাদের মেয়েরা জাতীয় দলে খেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে, এটা অনেক আনন্দের। মেয়েদের অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে ক্ষুদে ফুটবলারদের নিয়মিত অনুশীলন চলছে। এখানে আরও ৫০জন মেয়ে ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে থেকে আগামীতে আর নতুন নারী ফুটবলার জাতীয় টিমে খেলার সুযোগ পাবে।
কলসিন্দুর নারী ফুটবল টিমের ম্যানেজার মালা রানী সরকার কালবেলাকে বলেন,জাতীয় নারী ফুটবল দলে কলসিন্দুরের মেয়েরা খেলছে,আমাদের মেয়েরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অর্জন করেছে এটা অত্যন্ত গর্বের। আগামী দিনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে তারা আরও ভালো খেলা উপহার দেবে। নারী ফুটবলের এই উত্থান খুবই আশাব্যঞ্জক। তিনি আরও বলেন, ‘২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ দিয়ে ফুটবল শুরু করে কলসিন্দুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মেয়েরা। আজ এই কিশোরী ফুটবলাররা বিশ্বজয়ের দ্বারপ্রান্তে।’ আমি চাই কলসিন্দুরের নারী ফুটবলাররা আরও উঠে আসুক এবং বর্তমান সরকার প্রধানের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা কামনা করছি।
মেয়েরা ফুটবল খেলবে,একসময় গ্রামবাংলায় এটা ছিল অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতী রাণী শীল ও সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন। বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে ২০১৩, ২০১৪, এবং ২০১৫ সালে টানা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ক্ষুদে মেয়েরা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতেছেন অদম্য এই কিশোরীরা। বদৌলতে সরকারিকরণ হয়েছে তাদের কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অদম্য এই কিশোরীদের গল্প উচ্চ মাধ্যমিক শাখার একাদশ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ‘দ্য আনবিটেন গার্লস’ (অপরাজিত মেয়েরা) হিসেবে।
মেয়েদের জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন ময়মসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য ধোবাউড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মানিক বলেন,’এই অদম্য মেয়েরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমরা তাদের নিয়ে ভীষণ গর্বিত।’ মেয়েদের জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন।